চৈত্রের দ্বিপ্রহরে নয়নপুরের মেঠো পথ ধরে একটি রিকশা অগ্রসর হয়ে আসছিল। কোথাও কোন বাতাসের আভাস নেই। পথের দু’ধারে হরিৎক্ষেত্র নিথর। চৈত্রের তপ্ত রৌদ্রে রিকশাচালক ঘর্মাক্ত। রিকশাটিতে সওয়ারি হয়ে উপবিষ্ট অনুপম রূপবতী একটি রমণী। তার চেহারার লাবণ্যতা মলিন। মনোভাব রুষ্ট। রিকশাটি নয়নপুরের দীঘল মাঠ পেরিয়ে, পলাশপুর গ্রামের প্রারম্ভে এসে থেমে যায়। রূপবতী রমণীটি রিকশা থেকে নেমে ক্রুদ্ধ চিত্তে, ভারাক্রান্ত মর্মে পথের পার্শ্ববর্তী একটি বাড়িতে ঢুকে পড়ে।
বাড়িটি ভাষাসৈনিক আসলাম হোসেনের বাড়ি। রূপবতী রমণীটি পলাশপুরের ভাষাসৈনিক আসলাম হোসেনের কন্যা। রমণীটির নাম মুক্তি। নয়নপুর তার শ্বশুরালয়।
আসলাম হোসেন অলিন্দতে বসেছিল। হঠাৎ কন্যার আগমণে সে কিছুটা বিস্মিত হল। মুক্তি অলিন্দতে এসে, পিতাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল। আসলাম হোসেন হতভম্ব-নির্বাক। সে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। মুক্তির কান্নার রোল শুনে, মাতা সালেহা বেগম গৃহ হতে ছুটে আসে। অকস্মাৎ এ- পরিস্থিতি দেখে সেও স্তম্ভিত। মুক্তি কেঁদে কেঁদে পিতাকে বলে, বাবা, তুমি আমার গর্ব। তোমার আদর্শ আমার অহংকার। তাই সব জলাঞ্জলি দিয়ে তোমার আদর্শের কাছে ফিরে এসেছি, বাবা!
আসলাম হোসেন বিস্ময়ান্বিত হয়ে বলল, জলাঞ্জলি!
হ্যাঁবাবা! বাবা, তুমিত ভাষাসৈনিক ছিলে। বাংলা ভাষায় কথা বলার স্বাধিকারের জন্য আন্দোলন করেছিলে। সে জন্য কারাবরণও করেছিলে। কিন্তু কেমন করে এমন একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে, বল বাবা?
আসলাম হোসেন এবার বুঝতে পারল কন্যার মনোভাব। সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, হ্যাঁরে মা, ওটাই ছিল আমার জীবনের বড় ভুল। আমি একজন ভাষাসৈনিক হয়ে পারিনি মেয়েকে দেশপ্রেমিক, আদর্শবান একজন সু-পাত্রের হাতে তুলে দিতে। সেই ভুল আমি আজও শুধরাতে পারিনি।
মুক্তি নয়নের অশ্রু মুছে কিছুটা স্বাভাবিক হল; তারপর পিতাকে বলল, তোমার সে ভুল আজ আমি শুধরিয়ে এসেছি, বাবা! স্বামী-সন্তান সব জলাঞ্জলি দিয়ে তোমার আদর্শের কাছে ফিরে এসেছি। ও- বাড়িতে আমি যে, আর কোন দিন যাব না, বাবা!
মুক্তির মাতা সালেহা বেগম নীরবে সবই শুনলেন।
কন্যার এমন কঠোর সিদ্ধান্তে সে দ্বিমত করে বলল, অমন কথা বলতে নেই মা! রাগের বশে এসেছিস্, দু’চার দিন থেকে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
প্রত্যুত্তরে মুক্তি দৃঢ়কন্ঠে বলল, না-মা, আমি আর ঐ পাষণ্ডের সঙ্গে ঘর করব না।
সালেহা বেগম কন্যার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে প্রবোধ দিতে বলল, কেনরে মা? তুই যা বলছিস্, তারে দেখলে ত মনে হয় না, সে অতটাই নিষ্ঠুর।
মাতার প্রবোধ বাণীতে মুক্তি আরো রুষ্ট হল। সে রুষ্টচিত্তে বলল, দেশের প্রতি, বাংলা ভাষার প্রতি যার কিঞ্চিৎ পরিমাণ মমত্ববোধ নেই, তাকে কি বলবে? সেত মহা-কসাই। তুমি জাননা মা, দিন-রাত হিন্দি সিনেমা দেখবে, আর ইংলিশ ছাড়া কথা বলবে না। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটাকেও নষ্ট করে ফেলেছে। ছেলেটা এখন কথায় কথায় হিন্দি আর ইংলিশ বলে।
সালেহা বেগম অবাক হয়ে বলল, ওমা! তাতে কি হয়েছে; আধুনিক যুগ
মুক্তি আর মাতাকে বলতে দিল না। ক্রুদ্ধচিত্তে বাধা দিয়ে বলল, হ্যাঁআধুনিক যুগ। আধুনিক যুগ বলেই কি বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করতে হবে? বাংলা ভাষাকে বিসর্জন দিয়ে ইংলিশ আর হিন্দিতে কথা বলতে হবে? তার পর মুক্তি আবারও কাঁদো কাঁদোস্বরে বলল, মা, আমার চোখের সামনে আমার বাবার অর্জিত বাংলা ভাষার বিলুপ্তি ঘটাবে আমার স্বামী-সন্তান, এ যে আমি সইতে পারিনে, মা! বাংলা ভাষার বিলুপ্তিকারিরা যে, বঙ্গশত্র“। আমি একজন বঙ্গবীরের কন্যা হয়ে বঙ্গশত্র“র সঙ্গে যে, ঘর করতে পারি না, মা! আমার বাবার আদর্শের কাছে আমার স্বামী, সন্তান, সংসার সব তুচ্ছ। যে যাই বলুক; আমার বাবা আমার কাছে মহার্ঘ-রতন। আমার বাবা আমার কাছে মহান-মানুষ।
বাংলা ভাষার প্রতি কন্যার এমন মমত্ববোধ দেখে, আসলাম হোসেনের বুকটা যেন গর্বে ভরে উঠল। এ যেন যোগ্য পিতার যোগ্য কন্যা। আসলাম হোসেন খুশিতে বিহ্বল হয়ে কান্নারস্বরে বলল, বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন করে কারাবরণ করেছি। সমাজ, দেশ ও জাতি আমাকে কি দিয়েছে, তা কোন দিন ভেবে দেখিনি। কিন্তু আজ আমার বঙ্গজননী আমাকে শ্রেষ্ঠ সম্মানে ভূষিত করেছে। এর চেয়ে পরম পাওয়া আর কি হতে পারে? আজ আমি ধন্য। আয়আয় মা, আমার বুকে আয়তার পর মুক্তিকে বুকে নিয়ে সে কেঁদে কেঁদে বলে, তোকে যে, আর ও-বাড়িতে যেতে হবে নারে মা! তোকে আমি ওখানে যেতে দেব না! ও-বাড়িতে যে, তুই শান্তি পাবি না। এই বলে সে মুক্তিকে নিয়ে গৃহে চলে যায়।
ক্রমে-ক্রমে কয়েকদিন অতিবাহিত হল। মুক্তি পিতৃলয়ে অবাধভাবে নির্বিঘেœ দিন যাপন করতে লাগল। কিছুদিন পর শ্বশুরালয় হতে তার শ্বশুর করিম মন্ডল মুক্তিকে নিতে আসল। সঙ্গে তার পাঁচ বৎসরের ছেলে তুহিন। করিম মন্ডল আসলাম হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সবিস্তর খুলে বলল। কিন্তু আসলাম হোসেন কন্যার সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দিয়ে বলল, ‘মুক্তি আর স্বামী-গৃহে যাবে না।, তারা অলিন্দতে বসে বাক্বিতন্ডা করছিল। এমন সময় মুক্তি সে স্থলে এসে উপস্থিত হল।
মুক্তির শ্বশুর করিম মন্ডল মুক্তিকে দেখে বলল, বৌমা, অনেক হয়েছে; এবার ফিরে চলো। এই বয়সে আর পাগলামী করো না। অন্তত ছেলেটার মুখের দিকে একবার চেয়ে দেখো
মুক্তি একটু হেসে উঠল; তারপর হাসির অন্তরাল হতে ক্রোধের বহ্নি প্রজ্বলিত করে বলল, ছেলে! ওকে আমি গর্ভে ধারণ করেছি বটে, কিন্তু ওকে সন্তান বলে পরিচয় দিতে আমার বড় ঘৃণা হয়।
করিম মন্ডল উত্তেজিত হয়ে বলল, বৌমা, এত অহংকার ভাল নয়।
মুক্তি তার পিতা আসলাম হোসেনকে দেখিয়ে দিয়ে বলল, অহংকার! হ্যাঁ, এই যে সাধারণ এই মানুষটিকে দেখছেন না? সেই আমার অহংকার। বাংলা ভাষা আমার অহংকার। এদেশ আমার অহংকার। আপনাদের আভিজাত্য আছে, ঐশ্বর্য আছে; কিন্তু দেশের প্রতি, বাংলা ভাষার প্রতি কোন মমত্ববোধ নেই। তাই যদি থাকত, তবে এই শিশুটিকে জন্মের পর শেখাতেন না, মাকে মাম্মি বলতে আর বাবাকে ডেডি বলতে। মাতৃভাষাকে বিকিয়ে দিতে আপনাদের হৃৎপিন্ড একটুও কাঁপলনা। এই মাম্মি আর ডেডির জন্যই কি ৫২-তে রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল? এই মাম্মি আর ডেডির জন্যই কি সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার শত্র“র গুলির সম্মুখে বুক উজার করে দিয়েছিল? বলুন?
করিম মন্ডল স্তম্ভিত। মুক্তি রোষে বিক্ষুব্ধ হয়ে আবারও বলে, অর্থ-ঐশ্বর্যের দম্ভে এদেশকে দেশ বলে মনে হয় না, তাই না? বাংলা ভাষাকে ভাষা বলে মনে হয় না, হ্যাঁ? এতই যদি বিদেশ-প্রীতি, তবে এ-দেশ ছেড়ে চলে যান না কেন? কেন এ-দেশে থেকে অপসংস্কৃতির প্রচলন ঘটাচ্ছেন, বলুন? তারপর মুক্তি স্বীয়-সন্তান তুহিনকে দেখিয়ে দিয়ে বলল, ওকে নিয়ে এক্ষুনি এ-বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। আমি সময় মত তালাকনামা পাঠিয়ে দেব।
এমন সময় মুক্তির মাতা সালেহা বেগম গৃহ হতে ছুটে এসে বাধা দিয়ে মুক্তিকে বলল, চুপর্কচুপর্ক হতভাগী! অমন অলক্ষুণে কথা আর মুখে আনিস্না।
আসলাম হোসেন স্ত্রীকে বলে, সালেহা, ওকে বলতে দাও। ওকে যে বলতেই হবে। এত বছর পর আজ একটু স্বস্তি পাচ্ছি। আজ আমার বঙ্গজননী মুখ খুলেছে। ওকে যে বলতেই হবে, ওকে বলতে দাও সালেহা।
সালেহা বেগম উত্তেজিত হয়ে বলে, তুমি চুপকর। যত সব নষ্টের মূল। যে দেশের ভাষার জন্য আন্দোলন করে কারাবরণ করেছিলে; সে দেশ তোমাকে কি দিয়েছে, তা কি একবার ভেবে দেখেছ? দু‘বেলা দু‘মুঠো ডাল-ভাত খেয়ে কোন মতে বেঁচে আছো। তাছাড়া এত বছর পেরিয়ে গেল, পেরেছে কি তোমার অর্জিত বাংলা ভাষা এদেশে পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে?
প্রত্যুত্তরে পিতার পক্ষ অবলম্বন করে মুক্তি মাতাকে বলে, মা, সে জন্য বাবাকে কেন দোষারোপ করছ। এ-লজ্জা বাবার নয়; এ-লজ্জা এ-দেশের প্রতিটি মানুষের, প্রতিটি সমাজের। এ-লজ্জা জাতির পরম লজ্জা। কারণ, তারা বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করে, অবহেলিত করে। কিন্তু একবারও ভেবে দেখেছে কি তারা, এই বাংলা ভাষার অভ্যুদয়ে কত রক্তপাত হয়েছিল? কত প্রাণ জলাঞ্জলি দিতে হয়েছিল?
করিম মন্ডল স্তম্ভিত হয়ে সবই শুনলেন; কিন্তু একটুও অপমানবোধ করলেন না। দীর্ঘক্ষণ পর সে নীরবতা ভেঙ্গে মুক্তিকে বলল, বৌমা, এখনও সময় আছে তুমি বুঝতে চেষ্টা করো। তোমার ওসব নীতি-আদর্শের কথা বই পুস্তকে মানায়, বাস্তবতায় নয়।
করিম মন্ডলের কথায় প্রাধান্য দিয়ে সালেহা বেগম বলল, হ্যাঁমা, ছেলেটাকে আর মা-হারা করিস্নে।
মুক্তি তার সিদ্ধান্তে অটল। মুক্তি মাতাকে বলল, মা, বাংলা ভাষায় কথা বলার স্বাধিকারের জন্য বঙ্গজননীরা অনেক সন্তানকে জলাঞ্জলি দিয়েছিল। আজও ঘোচেনি বঙ্গজননীদের সন্তান হারানোর সে হাহাকার। আর শত শহীদের অর্জিত সেই বাংলা ভাষা রক্ষা করতে আমি মাত্র একটি সন্তানকে জলাঞ্জলি দিতে পারব না? পুত্রস্নেহের চেয়ে আমার কাছে বাংলা ভাষার মর্যাদা অনেক অনেক ঊর্ধ্বে। তারপর মুক্তি শ্বশুর করিম মন্ডলকে বলল, যান, তুহিনকে নিয়ে এ বাড়ি থেকে রেবিয়ে যান। আমি মা হয়ে যখন পারিনি সন্তানকে মাতৃভাষায় উদ্বুদ্ধ করতে, তখন সে সন্তানকে আমি জলাঞ্জলি দিলাম। বড় হলে কোন দিন ওকে আমার পরিচয় দেবেন না। আমি মা, আমি জানি ওর ভূত-ভবিষ্যৎ। কস্মিন্কালেও ওর মর্মে বাংলা ভাষার জন্য মমত্ববোধ হবে না। কারণ, ওর শরীরে বইছে মাতৃভাষার সন্ত্রাসীদের রক্ত।
করিম মন্ডল এবার অপমানবোধ করল। সে আর বিলম্ব করল না, অপমানিত চিত্তের ক্রোধে তুহিনকে নিয়ে গৃহ হতে বেরিয়ে গেল।
মুক্তি মাতা সালেহা বেগম কেঁদে উঠে বলল, মুক্তি, একি করলিরে মা, নিজের সংসার নিজেই ভাঙ্গলি? ওরে হতভাগী!
মুক্তি মাতাকে প্রবোধ দিতে বলল, মা, বাংলা ভাষা রক্ষার্থে এযে আমার জলাঞ্জলি। বাংলার প্রতিটি সমাজের প্রতিটি ঘরে ঘরে যদি আমার মত বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠার জন্য রমণীরা প্রয়াস করে, তবে একদিন এই দেশে বাংলা ভাষা পরিপূর্ণ ভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। কারণ, একমাত্র মা-ই পারে সন্তানকে বাংলা ভাষার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে তুলতে। আর মা হয়ে যে সন্তানকে মাতৃভাষার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে তুলতে পারবে না; সে সন্তানকে দিতে হবে জলাঞ্জলি! নচেৎ বাংলা ভাষার মহা-বিলুপ্তি ঘটবে। এই বলে সে কাঁদতে কাঁদতে গৃহে চলে যায়।
সালেহা বেগম কেঁদে কেঁদে স্বামীকে বলল, ওগো, মুক্তির সংসার, সন্তানসে আর বলতে পারল না। স্বামীকে জড়িয়ে ধরে শুধুই কাঁদতে লাগল।
আসলাম হোসেন স্ত্রীকে প্রবোধ দিতে বলল, কেঁদ না সালেহা, মুক্তি যা করেছে ঠিকুই করেছে। ওর মত মুক্তি যদি বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে থাকত; তবে বাংলা ভাষার এতটা অধঃপতন হত না। মুক্তি এ-বঙ্গের শ্রেষ্ঠ জননী; আর সে জননীর অভূতপূর্ব জলাঞ্জলি কালের বুকে চির-ভাস্বর হয়ে রবে। মুক্তি আমাদের অহংকার। মুক্তি আমাদের গর্ব। তারপর সে ভারাক্রান্ত মর্মে স্ত্রীকে নিয়ে অলিন্দ হতে স্ব-কক্ষে চলে যায়।
এক যুগ অতিক্রান্ত হল। এক যুগ পরেও মুক্তি আর স্বামী-গৃহে ফিরে যায়নি। কখনও মায়ের অধিকার নিয়ে সন্তানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়নি। তুহিন আজ কত বড় হয়েছে, কেমন হয়েছে, তা তার নিকট অবিদিতই রয়ে গেল।